আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের বাবা-মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য যেখানে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে শোরগোল হচ্ছে – সেই একই ধরনের রেওয়াজ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও বহু বছর ধরে চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে কোনও বাংলাদেশি পরিবার ধরা পড়লে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাবা-মাকে জেলে পাঠিয়ে দেয় – তবে তার বাচ্চাদের বয়স ছয় বছরের বেশি হলেই তাদের ঠাঁই হচ্ছে হোমে।
কিন্তু এরপর বছরের পর বছর ধরে সেই সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার আর দেখা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কর্মী, বিভিন্ন এনজিও-র প্রতিনিধিরাও মনে করছেন এই পদ্ধতিটা চরম অমানবিক – কিন্তু নিয়মের ফাঁদে এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর।
ভারতে ফরেনার্স অ্যাক্টের ১৪ এর ধারা অনুসারে অবৈধভাবে এ দেশে ঢুকলে সর্বনিম্ন দুবছরের আর সর্বোচ্চ আট বছরের জেল হতে পারে।
এই আইনে প্রতি বছরই বহু বাংলাদেশির ঠিকানা হয় ভারতের বিভিন্ন জেলে – কিন্তু সমস্যাটা আরও বাড়ে যখন তাদের সঙ্গে থাকে ছয় বছরের বেশি বয়সী ছেলেমেয়েরা।
জেনেভা ইউনিভার্সিটির গবেষক সুচরিতা সেনগুপ্ত বছর তিনেক আগে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের হয়ে এই বিষয়ে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।
তিনি জানান, “একেবারে ছোট বাচ্চা হলে তাদের জেলের ভেতরে মায়ের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়। কিন্তু বয়স ছয় বছরের বেশি হলেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় হোমে। বিভিন্ন জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এনজিওদের যোগাযোগ থাকে – আর ওই বাচ্চাদের ঠাঁই হয় সেই এনজিওর নিজস্ব হোমে। কিন্তু এরপর যেটা ঘটে, তা নিয়ে আমি দু-তিনরকম ভাষ্য পেয়েছি।”
“একটা হয়, পুলিশ সুপার ব্যক্তিগত আগ্রহ নিয়ে মায়ের সঙ্গে নিয়মিত বাচ্চাদের দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, অসম্ভব সাহায্য করেন আইনের বাইরে গিয়েও। কিন্তু পাশাপাশি বহু মা-ই আমাকে অভিযোগ করেছেন তারা একবার যখন জেলে চলে আসছেন তারা বাচ্চাদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন – তারপর কিন্তু পুরো জেল খাটার মেয়াদে তারা একবারও সন্তানের মুখ দেখতে পাননি!”
অথচ ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাত বছরের পুরনো নির্দেশই বলছে সার্ক দেশ থেকে কোনও অবৈধ অভিবাসী ভারতে এলে জেল নয় – তাদের হোমে রাখার কথা।
এ ধরনের হোম তৈরি হলে বাচ্চারা অনায়াসে বাবা-মার সঙ্গেই থাকতে পারত, কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা মাসুমের কিরীটি রায় বলছিলেন আজ পর্যন্ত সেই নির্দেশ মানার কোনও গরজই দেখা যায়নি।
মি রায়ের কথায়, “ওরা ‘ট্রানজিট হোম’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন – যেখানে রাখার পর তাদের প্রত্যাবাসন করার কথা। সেই নির্দেশ এসেছিল ২০১১ সালে, কিন্তু আজ সাত বছর বাদেও কোনও পক্ষ – তা সে রাজ্য সরকারের পুলিশ বা আদালতই হোক কিংবা কেন্দ্র সরকারের বিএসএফ – সেই নির্দেশে কোনও গা করেনি।”
“তারা গতানুগতিক পথেই যেভাবে চলছিলেন সেভাবেই আজও চলছেন। আরও যেটা দুর্ভাগ্যজনক, তা হল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এই বিষয়ে চোখ বুজে রয়েছে।”
ফলে এমন ঘটনা বহু ঘটেছে যেখানে মা-কে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাচ্চা এখানে পড়ে আছে। কিংবা বাচ্চা বাংলাদেশে চলে গেলেও মা-বাবা ভারতেই আটকে আছেন, জানাচ্ছেন কিরীটি রায়।
এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এমনটাও হয় যে সরকারি হোমে এসে পড়া বাংলাদেশি কিশোরের বাবা-মার সন্ধানই বের করা যায় না।
বহু বছর বাদে তার পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেলেও এমনও জানা গেছে যে, ততদিনে তার বাবা-মা হয়তো বেঁচেই নেই, বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সর্বশেষ চেয়ারপার্সন ইন্দ্রানী গুহব্রহ্ম।
তিনি বলছেন, “আমি এমন বহু ঘটনা দেখেছি যেখানে একদম বাচ্চা বয়সে হোমে এসেছে, হয়তো ঠিকমতো ঠিকানাই বলতে পারেনি। কিংবা বাংলাদেশের যে অ্যাড্রেস দিয়েছে সেখানে যোগাযোগ করে কাউকে পাওয়া যায়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে তারা হোমেই রয়ে গেছে।”
“তারপর একদিন হয়তো অনেক কষ্টে তার সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু দেখা গেল বাবা-মা আর বেঁচেই নেই, হয়তো তার দিদি বা বড় বোন কেউ নিতে এল। এখন সে আসল দিদি কি না, পরিচয়পত্র আসল কি না সে সব যাচাই করার পর বহু বছর বাদে হয়তো সে বাংলাদেশে ফিরতে পারল, কিন্তু বাবা-মার সঙ্গে এ জীবনে তার আর দেখাই হল না!”
কলকাতার এনজিও ‘সংলাপে’র নিজস্ব হোমেও বহু বছর ধরে আশ্রয় পেয়ে আসছে এই ধরনের বাচ্চারা।
সংলাপের অলোক বিশ্বাস বিবিসিকে বলছিলেন, আলাদা হয়ে পড়া রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে তাদের বাবা-মাকে মিলিয়ে দেওয়ার সময় তিনি যে ধরনের ট্র্যাজেডি দেখেছেন তা আরও মর্মান্তিক।
“রোহিঙ্গা অভিবাসীদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা আরও যন্ত্রণার। রোহিঙ্গা বাবা-মা হয়তো জেলে বা জেলের বাইরে আছেন, কিন্তু তাদের নিজের বাচ্চা যে নিজেরই – এটা প্রমাণ করতে তাদের জান বেরিয়ে যেত।
“তারা বলছেন এইটাই আমার বাচ্চা, সেই বাচ্চাও বলছে এইটাই আমার বাবা – কিন্তু প্রশাসন তাতে কান দিলে তো? তারা কাগুজে প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করবেন না, আর রোহিঙ্গা বাবারও ক্ষমতা নেই পয়সা খরচ করে কোনও রকমে একটা কাগজ বের করার!”, বলছিলেন বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণ ওই এনজিও কর্মী।
সুচরিতা সেনগুপ্তর গবেষণায় আবার উঠে এসেছে বহরমপুর জেলে সাত বছরের মেয়াদ খাটা জনৈকা ভাদুড়ীবালার কথা, চল্লিশ বছর বয়সী যে মহিলা চার বছর ধরে নিজের দুই বাচ্চা ছেলে-মেয়ের মুখ অবধি দেখেননি।
“ভাদুড়ীবালার জেলের মেয়াদ ছিল অনেক বেশি – কারণ সে যখন আটক হয় তখনও ফরেনার্স অ্যাক্ট সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ দুবছর করা হয়নি। তখন অনেক লম্বা শাস্তি হত, কারাবাসটাও চলত বহুদিন ধরে।”
“সেই মহিলা বারবার কান্নাকাটি করতেন আর বলতেন আমি একটিবার আমার ছেলেমেয়েকে দেখতে চাই – কিন্তু ওরকম কোনও পদ্ধতিই নেই, এত বছর হয়ে গেল ওদের একটিবারও দেখলাম না!” বলছিলেন মিস সেনগুপ্ত।
বহু ক্ষেত্রে স্রেফ যোগাযোগের অভাবেও যে জেলে থাকা মা-বাবা আর আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটানো ছেলে-মেয়ের দেখা হচ্ছে না, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
“এটা হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়, পুলিশ বা হোমের কোনও দোষ তা-ও ঠিক বলব না। কিন্তু এমনটাও হয় যে ওই জেল কর্তৃপক্ষ আর সংশ্লিষ্ট হোমের মধ্যে কোনও যোগাযোগই নেই, তারা একে অপরে হয়তো জানেনও না যে বাবা-মা এইখানে আর বাচ্চারা ওখানে আছেন।”
“এই কমিউনিকেশনের অভাবেই অনেক সময় মা জেল থেকে বেরোনোর আগেই বাচ্চাকে হোম থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিংবা বাচ্চা হোমে রয়ে গেলেও মা জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। দুজনের আর দেখা হওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে”, বলছিলেন সুচরিতা সেনগুপ্ত।
সুতরাং আইনের জটিলতাই হোক বা যোগাযোগের অভাব – ভারতে ঢুকে পড়া এমন অজস্র বাংলাদেশী বাবা-মাই নানা কারণে তাদের সন্তানদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন, কখনও কখনও সেটা হয়তো চিরতরেও।
সূত্র, বিবিসি